People Voice
জুলাই বিপ্লব

জুলাই আন্দোলনে হামলা মামলার আসামিও হলেন বাদী

গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হামলার অভিযোগে করা একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে তাঁকে। তিনিই আবার ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। তাঁর নাম কফিল উদ্দিন। পুলিশ জানায়, অস্ত্র, মাদক আইনে তিনটি মামলা রয়েছে কফিলের বিরুদ্ধে।

শুধু কফিল নন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হামলার অভিযোগে করা মামলার অন্তত ২০ জন বাদীর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। নানা ত্রুটিতে ভরা তাঁদের দায়ের করা মামলার এজাহার। অনেক আসামিকে চেনেন না স্বয়ং বাদী। মামলা থেকে বাদ যাননি চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকা লোকজনও।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় চট্টগ্রামে মামলা হয়েছে ১৪৮টি। এসব মামলায় ঢালাও আসামি করার অভিযোগ ওঠে শুরু থেকেই। তদন্ত চলা অবস্থায় একের পর এক আসামির নাম বাদ দিতে বাদীরা আদালতে আবেদন শুরু করেন। হলফনামা দিয়ে বাদীরা বলছেন ‘ভুলবশত’ আসামি করা হয়েছে। আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৪০ মামলা থেকে ৬৭৫ জন আসামির নাম বাদ দিতে আদালতে গেছেন বাদীরা। এ জন্য তাঁরা ৩৫৪টি আবেদন ও হলফনামা দিয়েছেন।

কফিল উদ্দিন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক উপঅর্থবিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরীর অনুসারী। গত বছরের ১০ নভেম্বর কোতোয়ালি থানায় ২৭৮ জনকে আসামি করে মামলা করেন মো. রাইয়ান নামের এক ছাত্র। সেখানে কফিলকে ২৩ নম্বর আসামি করা হয়।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামে হামলা, হামলার পরিকল্পনা ও হামলার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ এনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ১৮৭ জনের বিরুদ্ধে ১৯ নভেম্বর মামলা করেন সেই কফিল উদ্দিন। সেখানে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী রাইয়ানকে আসামি করেন। কফিল উদ্দিন বলেন, তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সরকারের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছেন। কোনো সুবিধার জন্য মামলা করেননি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিতে আহত হওয়ার পর মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। ওই ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ ৭০০ জনের বিরুদ্ধে ২০ সেপ্টেম্বর মামলা হয়েছে। তবে যিনি এই মামলার বাদী তাঁর নিজের বিরুদ্ধেই মাদক, মারামারি, এবং পরিবেশ আইনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কমপক্ষে পাঁচটি মামলা রয়েছে। নিহত হৃদয় চন্দ্র ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না বাদী আজিজুল হকের। হৃদয় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামের রতন চন্দ্র তরুয়া ও অর্চনা রানীর ছেলে।

হৃদয়ের বন্ধু পরিচয় দিয়ে থানায় এজাহার দিয়েছেন আজিজুল। আন্দোলনে অংশ না নিলেও ১৮ জুলাই ঘটনাস্থলে ছিলেন বলে তিনি মামলায় দাবি করেছেন। তবে হৃদয়ের সহপাঠীরা আজিজুলকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন। হৃদয়ের বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া বলেন, ‘কাঠমিস্ত্রির কাজ করতাম। এত দূর থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে আর মামলা করিনি’। আজিজুল দাবি করেন, তাঁর ভাই ফজলুল হকের সঙ্গে হৃদয়ের পরিচয় ছিল। এ জন্য মামলা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মীরা করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বেশির ভাগ মামলার বাদী সাজানো। অনেকে আসামিকে চেনেনও না। নেপথ্যে রয়েছেন মামলা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত চক্র। এতে আইনজীবী ও বিএনপির কিছু কর্মী রয়েছেন। অনেক মামলার বাদী অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামি। যথাযথ তদন্ত শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে তাঁরা পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।

বিদেশে থাকা ব্যক্তিও আসামি

চিকিৎসাকাজে ঘটনার সময় দেশের বাইরে থাকা ব্যক্তিও মামলার আসামি হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য গত আগস্টে ভারতের চেন্নাইয়ে ছিলেন যমুনা অয়েলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক মো. এয়াকুব। নগরের ডবলমুরিং থানায় ২০ নভেম্বর মোহাম্মদ মানিক নামের এক ব্যক্তির করা মামলায় এয়াকুবসহ ১০৮ জনকে আসামি করা হয়। এজাহারে এয়াকুবের নাম রয়েছে ৩৫ নম্বরে। তাঁর পাসপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনি গত ১ আগস্ট চিকিৎসার উদ্দেশ্যে চেন্নাই যান। তাঁর পাসপোর্টে চেন্নাই বিমানবন্দরের অভিবাসনের সিল রয়েছে। তিনি চিকিৎসা শেষে স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ৭ আগস্ট ঢাকা ও ৯ আগস্ট চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।

শাহাদাত হোসেন নামের এক প্রবাসী ব্যবসায়ীকেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া একজনকে মারধর, হত্যার চেষ্টা ও ককটেল বিস্ফোরণের মামলায় আসামি করা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজা ইউজড কার অ্যান্ড স্পেয়ার পার্টস অ্যাসোসিয়েশনের মালিক তিনি। গত বছরের ৪ আগস্ট নগরের কোতোয়ালি থানার আমতল এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ও হত্যার চেষ্টার অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়। ৯ ডিসেম্বর দায়ের করা এই মামলার বাদী জাহিদুল হাসান নামের এক ব্যক্তি। ওই মামলায় ৩০ নম্বর আসামি করা হয় ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেনকে। অথচ তিনি ঘটনার দিন শারজায় ছিলেন। ৮ আগস্ট তিনি দেশে আসেন। ১৩ আগস্ট তিনি শারজায় ফিরে যান। যার তথ্যপ্রমাণ বিমানবন্দরের অভিবাসন শাখা ও শাহাদাতের পাসপোর্টে সিল রয়েছে।

জুলাই আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় করা মামলার এসব অসংগতির বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) রাসেল আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে মামলা দিয়েছেন। অনেক নিরপরাধ লোককে আসামি করা হয়েছে, কিন্তু সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বাদ দেওয়া হোক।’

Related posts

গুলিবিদ্ধ হয়েও আন্দোলনে ফের গুলিতে চোখ নষ্ট

News Desk

বিচার শুরু হবে কবে পতিত স্বৈরাচারের?

News Desk

সাংবাদিক হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা

News Desk